আজ, সোমবার | ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১১:২৪


মাগুরার সম্প্রীতি, সম্প্রীতির শহর মাগুরা

লায়লা আরিয়ানি হোসেন : বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ছোট্ট এই জেলা, মাগুরা। আশেপাশের কয়েকটি জেলার সংযোগ রয়েছে এই জেলার সাথে। নবগঙ্গা আর গড়াই নদীর বয়ে যাওয়া, সবুজ মাঠ আর মানুষের মায়ায় গড়া এক শান্ত শহর। এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে, মানুষই মানুষের আশ্রয়। তাই কোনো উৎসব হোক, বিপদ হোক বা আনন্দের মুহূর্ত, সবখানেই একসাথে থাকে তারা, একে অপরের পাশে। এমন ছবি মাগুরায় অহরহ।

সম্প্রীতি বলতে, ব্যাক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত, সব ক্ষেত্রেই বোঝানো হয়। ইদানীং, দেখেশুনে মনে হয়, এ যেন শুধুই রাজনৈতিক আর ধর্মীয় বিষয়ে, অথচ মাগুরা শহরে দীর্ঘদিন ধরে যাদের বসবাস, তারা জানেন, এ শহরে যাদের শৈশব কৈশোর, কেটেছে, তারা বোঝেন এই সম্প্রীতি। চায়ের দোকানের আড্ডায় সৃজনশীল আলোচনা থেকে সকলের কুশল জানতে চাওয়া, প্রতিদিনের চর্চা  ছিল। কোন বিশ্বাস বা মতবাদের তোয়াক্কা করেনি নিখাদ বন্ধুত্ব।

মাগুরার পথ ঘুরে দেখা যায়, ধর্ম বা মতের ভিন্নতা এখানে দূরত্ব নয়, বরং রঙের মতো। আযানের সুরের ছড়িয়ে পড়া, সন্ধ্যা পূজার শাঁখের শব্দ, বসবাসে এক দেয়ালের তফাৎ, তবু চারদিক জুড়ে একটাই সুর বাজে, সম্প্রীতির। ধর্মীয় উৎসবে, এক হয় সবাই। চেষ্টা থাকে আন্তরিক, যেন সব আয়োজন সফল হয় সুন্দরভাবে। ঠিক পরিবারের সদস্যদের মত পাশে থাকার গল্প রয়েছে এ শহরের আনাচে কানাচে।

এ জেলার মানুষদের জীবনের গল্প ছোট হলেও মানবতার পরিধি বিশাল। মাগুরা মূলত কৃষিনির্ভর জনপদ। মাঠের পর মাঠে ধান, পাট, সবজির ফসল যেমন জন্মে, তেমনি জন্ম নেয় সহযোগিতার বীজ। কৃষক নিজের জমি থেকে ফসল তুললে পাশের বাড়ির মানুষকে কিছু না দিলে মন ভরে না। কারও ঘরে শোক এলে, আশেপাশের মানুষ রান্না করে নিয়ে যায়, এ যেন এক প্রাচীন মানবিক প্রথা, যা এখনো টিকে আছে এই মাটিতে।

মাগুরার মানুষ জানে, সম্প্রীতি মানে কেবল সহনশীলতা নয়, বরং একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ। এজন্যই সমাজে বিভেদের বাতাস বইলেও, এখানে তা সহজে ঢোকে না। গ্রামের রাস্তার পাশে বসে গল্প হয়, চায়ের দোকানে তর্ক হয় রাজনীতি নিয়ে, কিন্তু দিনের শেষে সবাই মিলে হাসে, কারণ তাদের সম্পর্কের শিকড় মাটির গভীরে, মনুষত্বের ভেতরে। এসবই দেখে এসেছি সেই ছোটবেলা থেকে।

এই জেলায় রয়েছে নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বাউল গান, যাত্রা, কবিগান, অষ্টক গান, ঝাপান খেলা, সং সাজা, সবই মানুষকে মিলিয়ে দেয় এক সুরে। গ্রামে গ্রামে লাঠিখেলা ও নৌকাবাইচ এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রকম খেলাধুলার আয়োজনে মুখর হয় মাগুরার বিভিন্ন গ্রামের মাঠগুলো। আবার শহরের কথাই ধরা যাক। পড়ন্ত সূর্যের সাথে ঘন হয়ে আসে ঐতিহ্যবাহী নোমানী ময়দানে মানুষের ভিড়। চলতে থাকে, কোথাও খেলাধুলার মহড়া, কোথাও বা গোল হয়ে বসে হাসি কান্নার সাতকাহন। টুর্নামেন্ট শুরু হলে, দর্শকের ভিড়। ইদের সকালে দেখা হওয়া এলাকাবাসীর সাথে। অনির্ধারিত গেট টুগেদার কোন বাড়িতে বা নদীর পাড়ে।

এই টানই আসলে সম্প্রীতির শিকড়। ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, মতবিভেদ, সব কিছুর ওপরে দাঁড়িয়ে মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, এই এক সত্য আজও মাগুরার বাতাসে বেঁচে আছে। আজকের পৃথিবী যেখানে বিভেদে ক্লান্ত, সেখানে মাগুরা আমাদের শেখায় একটাই কথা, সম্প্রীতি কোনো স্লোগান নয়, সম্প্রীতি যাপিত জীবনের অভ্যাস।

রোজার ঈদ বা কোরবানির ঈদ, দুর্গা পুজা বা কাত্যায়নী পুজা, শহরের মাটি চিনে ফেলে পরিচিত পায়ের আভাস। চায়ের দোকান যেন আনন্দে হাসে, দ্রুত হাতে প্রস্তুতি, আরও বেশি চা বানাতে হবে। কফির ফোমের কর্পোরেট উপস্থাপন যাদের জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ, তারাও দুপুরের ভাতঘুম উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ে কাঁচা পাতা আর গরুর ঘন দুধের ঘ্রাণ মাখা চা নামের মায়ার টানে। কেউ বা আদা লেবু দিয়ে লিকার, তবু একসাথে। মুখগুলো চেনা অচেনা, কিছুটা ঝাপসা হলেও, মাগুরার মানুষ ভেবেই আপন মেনে, নরম দৃষ্টিতে চলে কুশল বিনিময়। যেভাবে মানুষ সকালবেলা বের হয়ে  যায়, বিকেলে ঘরে ফেরে, ঠিক তেমনভাবেই পরস্পরের পাশে দাঁড়ায়, চুপচাপ, গভীর ভালোবাসায়।

শীতের ঠাণ্ডা জমাট হবে, নলেন গুড়ের মিশ্রণে তৈরি হবে ছানা আর এলাচ সুগন্ধি অনন্য মিষ্টি, প্যাঁড়া সন্দেশ। সরকারি চাকরীর সুবাদের আসা অন্য জেলার মানুষদের মায়া পড়ে যায় নিত্য, মনের ভিতরে ওই প্যাঁড়া সন্দেশের স্বাদের মতই সময়ের মিষ্টি পিছু ডাক রয়ে যায়। বহু যুগ পরেও, মাগুরা নামটি শুনলে বা পরিচিত নাম দেখে, জানতে চায়, মাগুরা অনেক বদলে গেছে, নাকি আগের মতই?

স্কুলের মাঠে জাতীয় দিবসে প্যারেডের প্রস্তুতির সময়, দারুণ আড্ডা হত। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আয়োজন, কবিতায় গানে মুখর থাকতো এই ছোট্ট জনপদ। কে কার থেকে ভালো করবে, তার চেয়ে যে যার নিজের মত ভালো করতে চেষ্টা করত। তুমুল প্রতিযোগিতা হত, যার অর্জন যাই থাক, হারজিতের মীমাংসা শেষে সেলিব্রেশন হতো সবাইকে নিয়ে।

এ শহরে শিক্ষার ঐতিহ্য বহুদিনের। তাই রয়েছে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা, রয়েছে লাইব্রেরী। স্কুল কলেজের মাঠ, ক্লাসের পরেও মুখর হতো। কেউ খেলতে আসতো, কেউবা সময় কাটাতে, গল্প করতে। স্কুল কলেজের সিনিয়র জুনিয়র সবাই মিলেই দুরন্ত এক সময় কেটেছে অনেক বিকেলে। পাবলিক লাইব্রেরীতে হয়ে যেত ছোটোখাটো অনুষ্ঠান। আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, আন্তরিক উপস্থিতিতে হয়ে মিলন মেলা হতো আনন্দের।

তথ্য প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, ভালোবাসা মায়া মমতা, পৃথিবীকে রাখে বাসযোগ্য। সোশ্যাল মিডিয়া, প্রতিযোগিতা, ছুটে চলা, থাকুক যত, আপন মানুষের জন্য পথ চাওয়া রয়েই যাবে। দিন শেষে মানুষ, মানুষকেই খুঁজবে। বিভেদ, বিসম্বাদ তৈরি হয় মানুষের স্বার্থেই। সব কিছুর উপরে, মানবিক স্বত্বা জেগে থাকলে, জীবন থাকবে যত্নে।

এই মাটির গন্ধে মিশে আছে বিশ্বাস, মানুষ যদি মানুষকে না ভালোবাসে, তবে পৃথিবী তার অর্থ হারাবে। মাগুরা  শুধু একটি জেলার নাম নয়; এটি এক উদাহরণ, কেমন করে সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের জীবনেই গড়ে তোলে অসাধারণ সম্প্রীতির গল্প। এই গল্পগুলো নতুন করে লেখা হোক। উড়ে যাক দূরে স্বার্থের হানাহানি সকল দ্বন্ধ, সংঘাত। মানচিত্রে আর মানুষের বুকে, মাগুরা রয়ে যাক একান্ত আপন হয়ে।
লেখক পরিচিতিঃ উপস্থাপক, বাংলাদেশ বেতার, কন্টেন্ট লেখক, লাইফ কোচ, মেডিটেশন ট্রেনার।

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology